কুমারী পূজা
কুমারী পূজা
কুমারী পূজায় বিভিন্ন বয়সের কুমারী অথবা কন্যা:
কুমারী পূজা তে বিভিন্ন বয়সের কন্যাকে অথবা কুমারীকে পূজা করা হয়। বিভিন্ন বয়সের কন্যাকে বিভিন্ন নামে জানা যায়, যেমন
১ বছরের কন্যা সন্ধ্যা,
২ বছরের কন্যা সরস্বতী,
৩ বছরের কন্যা কৃষ্ণমূর্তি,ত্রিধামূর্তি
৪ বছরের কন্যাকে কালিকা,
৫ বছরের কন্যা সুভাগা,
৬ বছরের কন্যা উমা
৭ বছর কুমারী মালিনী,
৮ বছরের কন্যা পঞ্জিকা,
৯ বছরের কন্যা কালসন্দর্ভা,
১০ বছরের কন্যা অপরাজিতা,
১১ বছরের কন্যাকে রুদ্রাণী,
১২ বছরের কন্যাকে ভৈরবী,
১৩ বছরের কন্যাকে মহালক্ষ্মী,
১৪ বছরের কন্যাকে পঠিনায়িকা,
১৫ বছরের কন্যা কে ক্ষেত্রজ্ঞা
১৬ বছরের কন্যা কে কুমারী পূজার মধ্যে অম্বিকা নামে পূজা করা হয়।
সনাতন হিন্দু ধর্মে কুমারী রূপে মাতৃ আরাধনা সুপ্রাচীন ৷ ঋগ্বেদের দেবী সূক্তে , ত্রৈতেরীয় আরণ্যক , বিভিন্ন পুরাণ এবং মহাভারতের ভীষ্ম ও বিরাট পর্বে কুমারী পুজোর কথা আছে ৷ অর্জুন কুমারী পূজা করেছিলেন ৷শ্বেতাশ্বতর উপনিষদেও রয়েছে কুমারীর উল্লেখ ৷ তবে , রামচন্দ্রের রাবণ বধের জন্য দেবগণ যজ্ঞের জন্য
ব্রহ্মার কাছে এলে তিনি দেবীর আদ্যাশক্তির স্তব করতে বলেন ৷ তখন দেবী আর্বিভূত হয়ে মর্ত্যে এক বেলগাছতলায় বোধন করতে পরামর্শ দেন ৷
ব্রহ্মা এসে দেখেন বেলগাছের পাতায় একটি ছোট
শিশু কন্যা নিদ্রিত আছেন ৷ সেই শিশু কুমারীকে পুজো করে তুষ্ট করে রাবণ বধের বর লাভ করেন ৷মাতৃত্ব ও দেবুত্ব প্রতিটি মহিলার আজন্ম সম্পদ ৷
তাই আশ্বিনের শুক্ল অষ্টমী তিথিতে কোথাও
বা সপ্তমী বা নবমীতে দুর্গাপূজার অঙ্গ হয়ে দাঁড়িয়েছে "কুমারী পূজা" ৷ কুমারী প্রকৃতি বা নারী
জাতির বীজাবস্থা ৷তন্ত্র মতে ১ থেকে ১৬ বছরের আর দেবী ভাগবত অনুযায়ী ২ থেকে ১০ বছরের
অজাতপুষ্প বা অরজঃস্বলা বালিকাদের কুমারী রূপে পুজো করা
হয় ৷ সেখানে লেখা হয়েছে দশ বছর বয়স পর্যন্ত মেয়েকে কুমারী হিসাবে পুজো করার কথা
"অত ঊর্দ্ধং ন কর্তবিং সর্বকার্য বিগর্হিতা "৷
বিশ্বসার বইয়ে কুমারীর লক্ষণ বলা হয়েছে ৷-
" অষ্ট বর্ষা তু সা কন্যা ভবেদ্ গৌরী বরাননে ৷
নববর্ষা রোহিনী চ দশবর্ষা তু কন্যকা ,
অত ঊর্দ্ধা মহামায়ে , ভবেৎ যৈব রজস্বলা "৷
৷ পাদ্য , অর্ঘ্য, ধূপ, দীপ, ফুল
ও নৈবেদ্য দিয়ে ষোড়শোপচারে এই পুজো করা হয় ৷আমাদের ধর্মমতে ,সব স্ত্রীলোক মহামায়ার অংশ
বা এক একটি বিশেষ রূপ ৷ আর শুদ্ধসত্ব কুমারীতে ভগবতী অধিক প্রকট ৷ কুমারী সরলতা, ভালোবাসা , নিরহঙ্কার ও মানবতার প্রতীক ৷ কুমারী শক্তি বিশ্ব প্রসবিনী ৷ঈশ্বরের ভাব অনন্ত , তাই যে কোন ভাব অবলম্বন করে ভগবানের আরাধনা করা যায় ৷ তাই , মাটি ,
পাথরের প্রতিমার বদলে চেতন কুমারীতে চৈতন্যময় ঈশ্বরের উপাসনা করা হয় ৷ কুমারী পুজোর মধ্যে দিয়ে আমরা জগন্মাতাকে নিজের
করে নিয়ে তাঁর শরণাগত হওয়ার প্রয়াসী হই ৷ পুরাণে কুমারী রূপে দেবীর কোলাসুর বধের কথা আছে ৷ যোগিনীতন্ত্রে লেখা আছে ব্রহ্মার শাপে বিষ্ণুর দেহে পাপ সঞ্চার হলে তিনি হিমাচলে মহাকালীর আরাধনা ৷ দেবীর সন্তুষ্ট হলে বিষ্ণুর পদ্ম থেকে সহসা "কোলা" নামের এক মহাসুরের আবির্ভাব হয় ৷কুমারী রূপে মা কোলানগরী গিয়ে কোলাসুরকে হত্যা করেন ৷রামকৃষ্ণ মিশনের নানা কেন্দ্রে কুমারী পুজো ব্যাপকভাবে প্রচলিত ৷ রামকৃষ্ণ পরমহংস
ষোড়শী রূপে মা সারদার পুজো করেছিলেন ৷ স্বামী বিবেকানন্দ ১৮৯৮ সালে কাশ্মীর ভ্রমণ কালে এক মুসলমান কন্যাকে কুমারী রূপে পূজা করেন ৷ ১৮৯৯ সালে কন্যাকুমারী গিয়ে স্বামীজী সেখানকার ডেপুটি একাউন্টেট জেনারেল মন্মথ ভট্টাচার্যের মেয়েকে কুমারী রূপে পূজা করেছিলেন ৷ সারদা দেবীর উপস্থিতিতে স্বামী বিবেকানন্দ নিজে
বেলুড় মঠে কুমারী পূজা করেছিলেন ৷সেবার ১৯০১ সালে সেখানে ৯ জন কুমারীকে পুজো করা হয় ৷ বিবেকানন্দের চোখে সব কুমারীই দেবীর এক একটি রূপ ৷এর দার্শনিক তত্ত্ব হলো নারীতে পরমার্থ দর্শন ও পরমার্থ অর্জন !আসলে ব্রহ্মান্ডে সৃষ্টি , স্থিতি ও লয় এই ত্রিশক্তির ক্রিয়ার শক্তি বীজাকারে কুমারীতে নিহিত ৷ শিব পার্বতীকে বলেছিলেন ," কুমারী পূজনং কৃত্বা ত্রৈলোক্যং বশমানয়েৎ "৷অর্থাৎ স্বর্গ , মর্ত্য ও পাতাল জয় করা যায় ৷ রুদ্রযামলে নবমীতে কুমারী পূজার কথা বলা হয়েছে ৷ দুর্গা পূজার সম্পূর্ণ ফল পেতে কুমারী পূজা করা উচিত ৷
" হোমাদিকং হি সকলং কুমারী পূজনং বিনা ,
পরিপূর্ণ ফলং স্যাৎ পূজয়া তদ্ ভবেদ্ ধ্রুবম্ ৷
কুমারীপূজয়া দেবী ফলং কোটিগুণং ভবেৎ ৷৷"
( তন্ত্রসার ৬৪২ পাতা ৫৭নম্বর শ্লোক ) ৷ বৃহৎ তন্ত্রসার আরো বলেছে ," কুমারী যোগিনী সাক্ষাৎ কুমারী পরদেবতা "৷ আগমতত্ত্ববিলাস গ্রন্থে সুন্দরী ও সুলক্ষণা কুমারীর
পুজোর কথা লেখা আছে ," কুমারী পূজনীয়া চ ভূষনীয়া চ ভূষনৈঃ "৷ যোগিনী তন্ত্র ( পাতা ১৭৭ , শ্লোক -৩০ ) বলেছে ," কুমারী পূজা ফলং বক্তুনার্হসি সুন্দরী "৷
সনাতন ধর্মের দৃষ্টিতে নারীকে ভোগ্যা রূপে নয় পূজ্যা রূপে দেখা হয়েছে ৷তাই মনুসংহিতা লিখেছে
," যত্র নার্যস্তু পূজ্যন্তে রমন্তে তএ দেবতাঃ ৷
যত্রৈতাস্তু নপূজ্যতে সর্বাস্তত্রাফলা ক্রিয়া "৷ সাধন পদ্ধতিতে বিশ্বজননী মহামায়া আদ্যাশক্তি কুমারী নারীমূর্তিতে সাধকের কাছে ধরা দিয়েছেন ৷বলা যেতে পারে এখনকার কুমারী পুজো স্বামীজীর অবদান ৷ মহাষ্টমী পূজার পর আবার কোথাও নবমী পূজার হোম যজ্ঞ শেষে নির্দিষ্ট কুমারী কন্যাকে স্নান করিয়ে নতুন শাড়ি পরিয়ে ফুল ও গহনা দিয়ে সাজিয়ে পা ধুইয়ে কপালে তিলক এঁকে পুজোর নির্দিষ্ট বেদী বা আসনে বসিয়ে পূজার নৈবেদ্য দিয়ে পুজো করা হয় ৷ এতে বোঝা যায় হিন্দু ধর্মে নারীকে কতখানি মহান মর্যাদায় বসিয়ে সম্মান ও শ্রদ্ধা করা হয় ৷নিজেদের পশুত্বকে সংযত রেখে নারীকে মাতৃরূপে সম্মান জানানো এর লক্ষ্য ৷এর ফলে মন হয় চৈতন্যযুক্ত তথা কলুষতামুক্ত ৷ মেরুতন্ত্রে বলা হয়েছে ," সব কামনা সিদ্ধির জন্য ব্রাহ্মণ কন্যা , যশোলাভের জন্য ক্ষত্রিয় কন্যা , ধনলাভের জন্য বৈশ্যকন্যা এবং পুত্র লাভের জন্য শুদ্রকন্যা কুমারী রূপে পূজা করতে ৷ তাই মহাদেব যোগিনী শাস্ত্রে বলেছেন ,"শত কোটি জিহ্বায় কুমারী পূজার ফল বলতে পারবো না ৷দেবী পুরাণে বলা হয়েছে শুদ্ধাত্মা কুমারীতে ভগবতীর প্রকাশ ৷ ১৯০১ সাল থেকে প্রতিবছর বেলুড় মঠে কুমারী কন্যাকে স্নান করিয়ে নতুন শাড়ি পরিয়ে , কপালে চন্দনের ফোঁটা পরিয়ে , গলায় ফুলের মালা দিয়ে এবং দু পায়ে আলতা পরিয়ে দেবী রূপে সশ্রদ্ধে পুজো করা হয় ৷ উত্তরপ্রদেশে গাজীপুরে বিবেকানন্দ ১৯০০ সালে মণিকা নামের একটি প্রবাসী মেয়েকে কুমারী রূপে পুজো করেছিলেন পরবর্তীতে তিনি সন্ন্যাসিনী হয়ে যশোদা মাঈ হিসাবে পরিচিত হন ৷
গত ২০১৯ সালে বেলুড়ে ৫ বছর ৯ মাস ৬ দিন বয়সী আরাধ্যা ভট্টাচার্যকে "সুভাগা" রূপে পুজো করা হয়েছিল ৷ ঢাকার রামকৃষ্ণ মিশনে পূজিত হয়েছিল প্রিয়তা বন্দ্যোপাধ্যায় নামের একটি ছোট্ট মেয়ে ৷দৈনিক ইত্তেফাক অফিসের কাছে রামকৃষ্ণ মিশনে অনেকবার এই অনুষ্ঠান দেখেছি ৷ আমার নিকট আত্মীয়াদের মধ্যেও শৈশবে কুমারী রূপে পূজিতা হয়েছে ৷ দুর্গা পুজোয় বেশী হলেও কালী , জগদ্ধাত্রী ও অন্নপূর্ণা পূজাতেও অনেক জায়গায় কুমারী পূজা হয় ৷মাদুরাইয়ের মীণাক্ষী আম্মান মন্দিরে , আসামের কামাখ্যা মন্দিরে ও কন্যাকুমারী মন্দিরে ধূমধাম করে কুমারী পূজা হয় ৷তাই আজ কুমারীর ধ্যান করি
"ওঁ বালরূপাঞ্চ ত্রৈলোক্যসুন্দরীং বরর্ণিনীম্ ৷
নানালঙ্করভূষাঙ্গী ভদ্রবিদ্যা প্রচাশিনীম্ ৷
চারূহাস্যং মহানন্দহৃদয়াং শুভদাং শুভাম্ ৷
ধ্যায়েৎ কুমারীং জননীং পরমানন্দরূপিনীম্ "৷৷আসুন আমরা সবাই বলি - " মা তুমি
ত্রৈলোক্যসুন্দরী , কিন্তু তুমি আজ সুভাগা ( যে বয়সী কুমারী পূজিত হবেন সেই নামে) রূপে আমার সম্মুখে উপস্থিত ৷ তুমি জ্ঞানরূপিনী , হাস্য
ময়ী ও মঙ্গলদায়িনী ৷" আমি তোমাকে প্রণাম করি৷
Comments
Post a Comment