শিব কী ?
শিব কী ?
সত্য ও সুন্দরই শিব। এই পৃথিবীতে সবাই সত্যকে, সুন্দররূপে মঙ্গলকেই চায়। কেউই
অমঙ্গল, অসুন্দর, অশিবকে চায়না। ফলে সকলেই এই শিব পূজার অধিকারী।
শিব লিঙ্গম কি?
“লীনং বা গচ্ছতি, লয়ং বা গচ্ছতি ইতি লিঙ্গম্” যা লয়প্রাপ্ত হয় তাই লিঙ্গ। আবার
কারো মতে সর্ববস্তু যে আধারে লয়প্রাপ্ত হয় তাই লিঙ্গম। কিন্তু
বৈয়াকরণিকগণের মতে "লিঙ্গতে চিহ্নতে মনেনেতি লিঙ্গম্"। লিঙ্গ
শব্দের অর্থ 'প্রতীক' বা 'চিহ্ন'। যার দ্বারা বস্তু চিহ্নিত হয়, সত্য পরিচয় ঘটে
তাই-ই লিঙ্গ। অর্থাৎ যার দ্বারা সত্যবিজ্ঞান লাভ হয়, যার সাহায্যে
বস্তুর পরিচয় পাওয়া যায় তাকেই বস্তু পরিচয়ের চিহ্ন বা লিঙ্গ বলে। আর এজন্যই দেহ প্রকৃতিতে লীনভাবে অবস্থান করে বলেই চিদ্ জ্যোতিকে বলা হয় লিঙ্গ। ভূমা ব্রহ্মের গুহ্য নাম "শিব" এবং ভূমা ব্রহ্মের পরিচায়ক বলে আত্মজ্যোতির উদ্ভাসনের নাম
শিবলিঙ্গ।
শিবলিঙ্গের আবির্ভাবঃ মাঘে কৃষ্ণচতুর্দ্দশ্যাম আদিদেবো মহানিশি।
শিবলিঙ্গ তয়োদ্ভুতঃ কোটিসূর্য্যসমপ্রভঃ।। মাঘ মাসের কৃষ্ণ
পক্ষীয় চতুর্দশী তিথির মহানিশিতে কোটি সূর্য সমপ্রভ তেজোময় আদিদেব
(জ্যোতিমূর্তি) লিঙ্গমূর্তিতে আবির্ভূত হন।
শ্রী রামচন্দ্র কতৃক শিবের আরাধনাঃ
প্রলয়ের কারণ বলে লোকে মহাদেবকে লিঙ্গ বলে। এই লিঙ্গ ব্রহ্মের পরম শরীর।
আর এ জন্যই ত্রেতাযুগে রাবণ বধে যাত্রার সময় সেতুবন্ধে শ্রীরামচন্দ্র
রামেশ্বরে শিবের পূজা করেন। আবার পরশুরামও পশুপতি শিবের তপস্যা করেই
পশুপাত অস্ত্র লাভ করেন।
শ্রীকৃষ্ণ কর্তৃক লিঙ্গপূজাঃ
দ্বাপরযুগে শ্রীকৃষ্ণ তাঁর স্ত্রী রুক্নী সহ উপমন্যু মুনির আশ্রমে গমন করেন এবং তথায় দেবতা,
ঋষি ও পিতৃগণের তর্পণান্তে অমিত মহাদেবের লিঙ্গমূর্তিতে পূজা করেন।
আবার শ্রীকৃষ্ণ মার্কণ্ডেয় মুনির আশ্রমে
গিয়ে ভুতিভূষণ শিবের পূজা করেছিলেন।
শ্রীকৃষ্ণের শিবের আরাধনার কারণঃ
"মহাদেব আত্মারই মূল। ইহা জানাবার জন্যই আমি তাঁহার পূজা করছি।
বেদতত্ত্বজ্ঞ পন্ডিতগণ আমাকেই শিবলিঙ্গ বলে থাকেন। অতএব আমি
স্বয়ং আপনাতে আপনি মহাদেবের পূজা করছি। আমি শিবময়, ফলে
আমাদের মধ্যে রূপ ভিন্ন হলেও কোন প্রভেদ নেই। সংসারে-ভীরু এবং অসত সাধারণ লোক
লিঙ্গমূর্তিতে দেবাদিদেব মহেশ্বরের ধ্যান ও পূজা বন্দনা করবে না এবং তারা সব সময় শিব নিন্দা করবে।
শিবতত্ত্বঃ
জ্ঞানের রাজ্য পার হয়েই জানা যায় শিবকে। জ্ঞানদায়িনী
দেবী সরস্বতী পূজার পরই আসে শিবরাত্রি। এরও একটি গভীর তাৎপর্য
আছে। দেবী সরস্বতী হংসরূঢ়া। হংসটি কিন্তু সাধারণ হংস নয়। মানুষের কূটস্থে
যে দ্বিদলপদ্ম আছে, এতে "হং" এবং "সঃ" দুইটি বীজ। এই দুইটি বীজে দৃষ্টি
স্থির রাখতে পারলেই জ্ঞান- বিজ্ঞান ও প্রজ্ঞানক্ষেত্র খুলে যায়।
আবার জ্ঞানক্ষেত্রে চতুর্বেদ রাগিনী সরস্বতী উপবিষ্ট। তাই
ইন্দ্রিয়- মন-বুদ্ধিকে সুসংযত করে কুটস্থে
রাখতে পারলে সরস্বতীর কৃপা লাভ সম্ভব।
জ্ঞানক্ষেত্র পার হলে পৌঁছা যায় ব্যোমক্ষেত্রে আমাদের কূটস্থের পর
দহরাকাশ, চিদাকাশ, পরাকাশ, মহাকাশ
ও আত্মাকাশ। এই পঞ্চ আকাশেই ব্যোমক্ষেত্র বা শিবক্ষেত্র। এ জন্যই
শিবের অপর নাম পঞ্চানন। মানুষ সাধন ক্রিয়া দ্বারা এই ব্যোমক্ষেত্রে
পৌছালে শিব শীঘ্র তুষ্ট হন। এ জন্য শিবের আর এক নাম আশুতোষ। এছাড়াও
শিব আরও যে যে রূপে মূর্ত হন তানিম্নরূপ :
০১। চন্দ্রনাথদেবেরই আর এক নাম শিব। শিব অর্থ মঙ্গল বা শুভ। পুনর্জন্ম নিরোধ
করে অর্থাৎ মোক্ষ দান করে তিনি জীবের মঙ্গলই করেন। তিনি আবার
পঞ্চানন নামেও খ্যাত। পঞ্চ আনন (মুখ) যাঁর তিনিই পঞ্চানন। পঞ্চমুখ দেবতাই শিব।
০২। 'ওঁ'-তত্ত্বের ত্রিদেবতা-ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও মহেশ্বর। পঞ্চানন শিবই এই
মহেশ্বর। মহেশ্বরী শক্তির অধিকারী তিনি। মহাপ্রলয়ের নটরাজ তিনি।
তিনি ঈশান নামেও খ্যাত। ঈশান-ই বিষাণে অর্থাৎ শিঙ্গায় ফুঁ দিয়ে তিনি মহাপ্রলয় ঘোষণা করবেন।
০৩। মহাশক্তির দেবতা মহেশ্বর। সকল দেবতা ঐক্যশক্তি দিয়ে যা করতে
পারেননা, মহেশ্বর একাকী তা সম্পন্ন করতে সমর্থ। দেবতার মাঝে বিচিত্র অদ্ভূতকর্মা দেবতা তিনি।
০৪। মৃত্যুকে জয় করেছেন বলে তিনি মৃত্যুঞ্জয়। তাইতো তিনি অকাতরে সমুদ্র
মন্থনের হলাহল অর্থাৎ বিষ কণ্ঠে ধারণ করেছেন। বিষের ক্রিয়ায় তার
কণ্ঠদেশ হয়েছে নীল। সে কারণে তার নাম নীলকণ্ঠ।
০৫। বাঘের চামড়াকে বলে কৃত্তি।কৃত্তি পরিধান করে নাম ধরেছেন কৃত্তিবাস।
০৬। বিচিত্রকর্মা মহেশ্বর। অর্থাৎ তার সকল কর্মই অদ্ভূত ও বৈচিত্র্যময়। গঙ্গার
ধারা ধারণকালে ত্রিশূল হাতে তিনি হিমালয়ের পাদদেশে থমকে
দাঁড়িয়েছেন এবং মস্তকের জটাজুটকে উত্থিত করে দিয়েছেন ব্যোমে অর্থাৎ
আকাশের দিকে এবং নাম ধরেছেন ব্যোম্কেশ। তার সেই উত্থিত
জটাজুটের মাধ্যমে গঙ্গার ধারা পৃথিবীতে নেমে আসে। তবেই না মর্ত্যের মানুষ
গঙ্গার পূত-পবিত্র সলিলে অবগাহন করে নিষ্পাপ হচ্ছে এবং মরণের পরে
স্বর্গবাসী হচ্ছে।
০৭। 'ধূর' শব্দের অর্থ জটাভার বা ত্রিলোকের চিন্তাভার। মহাদেব
চন্দ্রনাথই শিরে জটাভার ধারণ করেন অথবা ত্রিলোকের চিন্তাভার ধারণ ও
বহন করেন। এসকল ভার বহন ও ধারণের কারণে তারই নাম ধূর্জটি।
০৮। ভারতচন্দ্রের অন্নদামঙ্গল কাব্যে বলা হয়েছে-'কোন গুণ নাই তার
কপালে আগুন'। এখানে 'গুণ নাই'-এর অর্থ সত্ত্বঃ, রজ ও তম গুণের অতীত। মহাদেব
ত্রিগুণাতীত। তিনটি নেত্র বা লোচন তার। একারণে দেব ত্রিলোচনও বলা হয়
তাকে। তার ললাটের তৃতীয় নয়ন দিয়ে সর্বদাই ধক্ ধক্ করে আগুন জ্বলতে থাকে।
'কপালে আগুন' বলতে অন্নপূর্ণা দেবী ইঙ্গিতে মহাদেবের ললাট নেত্রের
কথাই বলেছেন। আগুন আলোর প্রতীক। অন্ধকার দূর করতে আলোরই প্রয়োজন।
তার ত্রিনেত্রের অগ্নি জ্ঞানরূপে আলো জ্বালানোর প্রতীক। অর্থাৎ
মানুষকে জ্ঞান-চর্চা করতে হবে।
০৯। ত্রিগুণাতীত বলে শিব সর্বদাই নির্বিকার নির্বিকল্প। তাই শবরূপে
তিনি শ্রীকালী মাতার চরণতলে শায়িত। শবরূপে শিব মানুষকেও বিকার
রহিত হওয়ার শিক্ষা দিয়েছেন। কারণ শবেরইতো কোন বিকার নেই। তার
ত্রিশূলও ত্রিগুণের প্রতীক। তিনি নিজে ত্রিগুণাতীত হয়ে মানুষকেও
তার হস্তধৃত ত্রিশূল দেখিয়ে ত্রিগুণাতীত হওয়ার শিক্ষা দিয়েছেন।
১০। শিব 'হর' এবং 'শম্ভু' নামেও খ্যাত। তিনি জীবের চিত্তকে, তাদের
পাপকে হরণ করেন এবং কালপূর্ণ হলে জীবের জীবনকেও হরণ করেন। এসকল হরণ
করার কারণে তার নাম 'হর'। আবার তিনিই জীবের যম-ভয় অর্থাৎ শঙ্কা হরণ
করে তাদের কল্যাণ সাধন করেন। তার নাম গ্রহণ করলেই আর কোন শঙ্কাই থাকে
না। এ কারণে শংকর তার নাম। আবার শম্' শব্দের অর্থও কল্যাণ। যেহেতু তিনি
কল্যাণ দান করেন, সেহেতু 'শম্ভু' নামেও তিনি বিশ্বখ্যাত।
১১। ত্রিপুর নামক অসুরের অত্যাচারে ত্রিপুরাবাসী অর্থাৎ স্বর্গ-মর্ত্য-
পাতালবাসী দেবতা, মানব এবং যক্ষকুল অতীষ্ট হয়ে উঠেছিলেন তখনশিব
শরাসন থেকে শর নিক্ষেপ করে ত্রিপুরাসুরকে নিধন করেন। আর এই
ত্রিপুরাসুরকে নাশ করে নাম ধরেছেন দেব ত্রিপুরারি।
১২। শিব অল্পেই বা শীঘ্রই সন্তুষ্ট হন। এ কারণে তাঁর এক নাম আশুতোষ।
১৩। শিব দেবগণ কতৃক বন্দিত, তাই তাঁর নাম মহাদেব।
১৪। শিব সকল জীবের প্রভু, তাই তিনি ঈশান।
১৫। শিবের জন্মদাতা বা জন্মদাত্রী কেউ নেই, তাই তিনি স্বয়ম্ভু।
১৬। পশু ও জীবের কর্মবন্ধন মোচন করেন বলে তিনি পশুপতি।
১৭। প্রতিকল্পে আপন লীলা মহিমায় তিনি ব্রহ্মাণ্ডের ধ্বংস সাধন করেন, তাই তিনি মহাকাল। সত্যই জগতের প্রতিটি বস্তুকণায় শিবের অস্তিত্ব বর্তমান। "যত্র জীব-তত্র শিব"-পরমপুরূষ
★ শ্রীরামকৃষ্ণ কঠোর তপসায় সিদ্ধিলাভ করে এ সত্যই উপলব্ধি করেছেন। সুতরাং
আমাদের সকলের উচিৎ জীব সেবার
মাধ্যমে শিব সেবায় ব্রতী হওয়া।
সেই পরমেশ্বর শিবের উদ্দেশ্যে
★ প্রণাম মন্ত্রঃ-
ওঁ নমঃ শিবায় শান্তায়
কারণত্রয়হেতবে। নিবেদয়ামি
চাত্মানং ত্বং গতিঃ পরমেশ্বর।।
Comments
Post a Comment