শিব রূপের রহষ্য
ওঁ নমঃ শিবায়।
শিব পুরাণে ভগবান শিবের নিরাকার নির্গুণ স্বরূপকে "সদা শিব", সগুন সাকার স্বরূপকে "মহেশ্বর", সৃষ্টিকর্তা রূপকে "ব্রহ্মা", পালনকর্তা রূপকে ভগবান "বিষ্ণু", আর সংহার রূপকে "রূদ্র" বলা হয়েছে। সাকার মহেশ্বরের দেহে অনেক চিহ্ন (Symbols) আছে। এগুলি হল—
ভষ্মধারী শরীর: ভষ্ম আকারের শেষ নিরাকার রূপ। মানব, পশু সবার অন্তিম আকার এই ভষ্ম। এই ভষ্ম ভগবান শিব শরীরে ধারণ করেন, অর্থাৎ শিবের শরীর থেকেই সবকিছুর সৃষ্টি আর অন্তে তার শরীরেই বিলীন।
জটা: মহাদেব অখন্ড যোগী। শিবের জটার তিনটি ধাপ যা মানবের তিনটি শক্তির প্রতীক, উপরের খোপা কেশ মানুষের শারীরিক শক্তি(তামসিক), মাঝখানের বীজ সহিত কেশ মানসিক(রাজসিক) আর প্রবাহিত খোলা কেশ আধ্যাত্মিক(সাত্ত্বিক) শক্তির প্রতীক।
গঙ্গা: শিবের মেঘরূপজটা থেকে গঙ্গার সৃষ্টি, যার জলে স্নান করে সমস্ত পাপ ও অশুভ দূর হয়ে পবিত্রতা প্রাপ্ত হয়।
চন্দ্রমা: চন্দ্র শোভিত শিবের জটা। চন্দ্র ওনার 'শৃঙ্গার/অলংকার', (নিজ দেহের) অংশ নয়। এর মানে চন্দ্র যেমন অমাবস্যা পূর্ণিমা নিয়ে আসে, ঠিক তেমন মানুষের প্রাপ্তি ধন, যশ আভুষণের মত হওয়া উচিত; নিজের অংশ বানানো উচিত নয়।
ত্রিনেত্র: ডান নেত্রে সূর্য, বাম নেত্রে চন্দ্রমা, আর মাঝখানের নেত্রে জ্ঞানাগ্নি। সূর্যের প্রকাশ ও চাঁদনির শীতলতা উভয়ই গ্রহন করতে হবে, আর জ্ঞানাগ্নি সমস্ত অন্ধকার দূর করবে। ধ্যানমস্ত আঁখি যা সৃষ্টির নির্মান স্বরূপ। নেত্র- আধাখোলা নেত্র অর্থ নতুন অন্তঃরীক্ষের জন্ম হচ্ছে, আর খোলা মানে নতুন অন্তরীক্ষ সৃষ্টি হয়ে গেছে।
কুন্ডল: নীলকন্ঠের কুন্ডল এর নাম অলক্ষয়া অর্থাৎ যা মানব চক্ষু দ্বারা অদৃশ্য। এই কুন্ডলেই সমস্ত মহাবিশ্বের রহস্য লুকায়মান যা, সমস্ত সৃষ্টির আধার।
সর্প: সাপ যোগীর মতই। যোগী যেমন ঘর, বস্ত্র কিছুই চাই না; সাপেরও ঘর নেই, নিজের চামড়া পর্যন্ত ত্যাগ করে। 'বাসুকী নাগ' তাই মহাযোগী শিবের অলংকার।
রুদ্রাক্ষ মালা: ভগবান মহেশ ১০৮ রুদ্রাক্ষ ধারণ করেন। রুদ্র ও অক্ষ- "রুদ্র" তথা স্বয়ম শম্ভু, "অক্ষ" তথা তত্ত্ব। এই ১০৮ তত্ত্ব হল সৃষ্টি নির্মানের তত্ত্ব।
ত্রিশুল: এই তিন শুল হল 'শক্তি, ইচ্ছা ও জ্ঞানে'র প্রতীক।
ডমরু: শিবজী মানব কল্যান হেতু নাদ সৃষ্টি করেন, যাহার মধ্যে ওঁ শব্দ(Sound) এর শক্তি বিরাজমান।
বরদমুদ্রা: শিবের ডান হাত সবসময় বর দান তথা জ্ঞানদান অবস্থায় থাকে, আর জ্ঞানের মার্গ স্বয়ম প্রভুর মার্গ।
শিবলিঙ্গ: আগম ধর্মসূত্রের তৃতীয় অধ্যয়ের ১৬-১৭ নং শ্লোকে বলা হয়েছে— লিন্(Lin)অর্থ বিলীন হওয়া এবং গ(ga) অর্থ উত্পন্ন হওয়া। অর্থাত্ যে মঙ্গলময় সৃষ্টিকর্তা(শিব) থেকে সবকিছু উত্পন্ন হয় এবং প্রলয়কালে সবকিছু যাতে বিলীন হয় তারই প্রতীক এই শিবলিঙ্গ।
স্বামী বিবেকানন্দ ১৯০০ সালে প্যরিসে হয়ে যাওয়া ধর্মসমূহের ঐতিহাসিক মূল শীর্ষক সম্মেলনে, বিশ্ববাসীর সামনে অথর্ব বেদের "স্কম্ভ সুক্তে"র সাহায্যে তুলে ধরেন যে, শিবলিঙ্গ মূলত বিশ্বব্রহ্মান্ডেরই প্রতীক।
স্বামী শিবানন্দ বলেন, "এটি শুধু ভূলই নয় বরং অন্ধ অভিযোগও বটে যে, শিবলিঙ্গ পুরুষলিঙ্গের প্রতিনিধিত্বকারী। তিনি লিঙ্গপুরানের নিম্নলিখিত শ্লোকের উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন—
"প্রধানাম প্রকৃতির যদাধুর লিঙ্গমুত্তমম গান্ধবর্নরসাহৃনম শব্দ স্পর্শাদি বর্জিতম"
অর্থাত্: লিঙ্গ হল প্রকৃতির সর্বোচ্চ প্রকাশক যা স্পর্শ, বর্ন, গন্ধহীন।
শিবলিঙ্গ কি? 'লিঙ্গ' শব্দের মূল অর্থ হলো সূক্ষ দেহ। এই দেহটিতে যুক্ত আছে পাঁচটি জ্ঞানেন্দ্রিয়, ৫টি কর্মেন্দ্রিয় এবং ৫টি প্রাণ অপান বায়ু, মন ও বুদ্ধি- মোট ১৭ টি অবয়ব যুক্ত দেহ। সকল সৃষ্টিরই সূক্ষ শরীর আছে। আমাদের যখন মৃত্যু হয় তখন জীবাত্মা সূক্ষ শরীরে বিচরণ করেন এবং পুনরায় দেহ ধারণ করেন। যে সূক্ষ শরীরকে আমরা লিঙ্গ বলে পূজা করি তা সৃষ্টির সূক্ষ শরীর প্রকৃতিতে বীজ বপনরূপ সূক্ষ বিষয়টিকে দেখানো হয়েছে।
Comments
Post a Comment